Tuesday 20 May 2014

পত্রাঘাত     



                                      ১লা আষাঢ়, ১৩২১সন
পূজনীয় পিতৃদেব

ঈশ্বরের কৃপায় আশা করি আপনি সুস্থ আছেন আপনার পত্র পাইয়াছি দুই দিন হইল আষাঢ় মাস পড়িল, আকাশ মেঘলা হইয়াছে , আর কয়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টি নামিবে আশা রাখি কলিকাতায় কিরূপ জল-কাদা হয় আপনাকে বর্ণনা করিবার সাধ্য আমার নাই, তাহার উপর একদা কলিকাতায় বাড়ি বানাইবার শখে আপনি যে অর্ধ-সমাপ্ত দুই কামরার বাসস্থানটি কোনরকমে বানাইয়াছিলেন এবং পরবর্তীকালে আমার হাতে তাহার দায়ভার তুলিয়া দিলেন, সেই বাসস্থানের দুরবস্থার কথা আমি আপনাকে আগের পত্রে সবিস্তারে জানাইয়াছি মাথার ওপর পাকা ছাদ ফেলিতে না পারিলে, আমার বাসাও যে কলিকাতার গঙ্গার ন্যায় দুইকুল ভাসাইবে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই ইতিমধ্যে আজইআষাঢ়স্য প্রথম দিবস 

আমার দপ্তরের খবর, বেতনের দুরবস্থা এবং বাসস্থানের এইরূপ অবস্থার কথা বিশদে জানাইয়া যে পত্র আপনারে দিয়াছিলাম, তাহা হইতে একটি কথা আপনি নিশ্চয় অনুধাবন করিয়াছেন যে, পত্রটির মূল বক্তব্য ছিল 
পয়সা নাই, কি যে খাই, ইতি-তোমার কানাই 
ইহার পর আপনার নিকট হইতে যে পত্র এল, তাহাতে আপনার শারীরিক অসুস্থতা এবং আরও নানাবিধ সমস্যার মর্মার্থ্য এইরূপ যে
পয়সা চেয়ে দিও না চাপ, ইতি- তোমার বাপ
(‘
বাপনামক অপভ্রংশের ব্যবহারের জন্য মার্জনা করিবেন, বর্ষাকাল আসিয়াছে, একটু কবিত্ব করিলাম) 

আমি একটি ব্যাপারে জ্ঞাত আছি যে, যযমানির দৌলতে আমার ঠাকুর্দা ভালই সঞ্চয় করিয়া গিয়াছিলেন এবং মিতব্যয়িতার দৌলতে আপনি তাহা অক্ষুন্ন রাখিয়াছেন এবং নিজেও সঞ্চয় করিয়াছেন ইহা আপনার একটি বিশেষ গুণ, আমি কখনও ইহারে ছোট করিয়া দেখি নাই 

কিন্তু আপনার চাহিদা পূরণে আমি অসমর্থ হইয়াছি, আপনার বংশে আজও একটি বংশধর এলনা, এই যন্ত্রনা আমিও বুঝি বড়দাদা যাত্রাদলে ভিড়িয়া গেলেন, আজকাল মাথায় একটি ক্ষুদ্র টিকি রাখিয়া কীর্তন গাহিয়া বেড়ান তিনি শ্রী কৃষ্ণের লীলা মাহাত্ম্য প্রচারে ব্যস্ত, সুতরাং তাহাকে সংসার ধর্মে ধরিয়া রাখিবার আমিও কেহ নই, আপনিও নন কনিষ্ঠ ভ্রাতা দেবু বিবাহ করিতে নারাজ তাহার সহিত জেলে পাড়ার ফুলকলির বিবাহ না দিয়া আপনি তাহাকে সুতীব্র যন্ত্রনা দিয়াছেন ইহাতেও আমার কোন হাত ছিলনা আমি বাধ্য ছেলের মত, কলিকাতার আপিসে ইংরেজের কনিষ্ঠ কেরানি রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, ছাদনাতলায় দাঁড়াইলাম, এবং বিবাহের দশমাস বাদে একটি কন্যাসন্তানের পিতা হইলাম ইহাতে যে আমার হাত নাই, একথা আমি কভু বলিব না, তবে বিজ্ঞান নাকি বলে ইহাতে আমাদের সততই কোন হাত নাই যাহা হউক এই ব্যাপারে আমি বিশেষ আলোকপাত করিতে পারিব না 

আমার স্ত্রী সুরবালা ইহার পর আরও দুইটি কন্যাসন্তানের মা হওয়াতে, আপনিভাগ্য পরিবর্তনেরজন্য রামানন্দ জ্যোতিষের নিকট যাইলেন ইহাতে আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল, কারণ আমি জানিতাম, লোকটি একটি অতিশয় চতুর লোক সে আপনারে কহিল যে পুত্রসন্তানের পিতা হইবার জন্য আমাকেপত্নী বদলকরিতে হইবে আর সেই সুযোগে তাহার ভ্রাতুষ্পুত্রী দ্বাদশ বর্ষীয়া কুমুদিনী কে আমার গলায় ঝুলাইলেন আপনার কড়া হুকুমে, সুরবালার নির্জলা উপবাস স্বরূপ প্রতিবাদকে তুচ্ছ করে, এই নিতান্ত অর্থনৈতিক দুরবস্থায় আমি পুনরায় একটি বিবাহ করিলাম 

আপনার গ্রামে আরামে দিনযাপন হয়, আপনি কি বা জানিবেন, কুমুদিনী কেকুমুবলিয়া ডাকিলে সুরবালা আমার প্রতি কেমন অগ্নিদৃষ্টি দেয় আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা সুধারানী, কুমুর থেকে তিন বতসরের বড়, সে কুমুরে মা বলিয়া ডাকিতে চাহেনা তাহার উপর আমি তাহার বিবাহের সময় সর্বস্ব দিয়াছি কেবল একটি দেরাজ-আলমারি এখনও দিয়া উঠিতে পারি নাই এই লইয়া তাহাকে জামাতা সকল সময়ে কটূক্তি করে ইহার উপর সে যখনপিতার বিবাহেরখবর শুনিল, সে আর আমার সাথে বাক্যালাপ করে না আপনি বলিয়া দেন, আমি কি করি? 
সুরবালার শরীরে মেদের আধিক্য প্রবল হওয়াতে তাহাকে বাতে ধরিয়াছে, তাহার হাতে পায়ে নিয়মিত তেল মালিশ করিতে হয় মেজকন্যা রাধারানী বিবাহের যোগ্য হইয়াছে, ভাল সম্বন্ধ আসিয়াছে, কিন্তু তাহারা বরপণ বাবদ তিন হাজার টাকা দাবি করিয়াছেন আমি দিগভ্রান্ত 

একটি ভাল খবর আছে, যাহার আশায় আপনি আমার এমন অবস্থা করিলেন, তাহা হইল কুমুদিনী এখন তিনমাসের অন্তসত্ত্বা তবে এক্ষেত্রে পুত্রসন্তান যে হবেই, এমন কোন নিশ্চয়তা আমি দিতে পারিনা কুমুদিনীর পরে কোনতরঙ্গিনীআমার গলায় ঝুলিতেছে কিনা, তাহা নির্ধারন করিবেন আপনি সুরবালার সহিত চোখে চোখ রেখে কথা কহিতেও আমার বাধে

এদিকে কুমু নিত্য সুরবালার পায়ে তেল মালিশ করিয়া কিছুটা তাহার মন জয় করিতেছিল, তাহার শরীর খারাপ হওয়াতে সে এখন বেশিরভাগ সময় শুইয়া থাকে এবং হাট হইতে মাছ আসিলে, তাহার আঁশ ছাড়ান, কাটা, রান্না করে, খেয়ে না ফেলা অবধি সে পাশের বৈষ্ণব বাটিতে গিয়া বসিয়া থাকে মাছের গন্ধ তাহার কাছে বিষস্বরূপ এখন তাহার উপর রাতের বেলা সুরবালার বাতের ব্যাথা বৃদ্ধি পাইলে, কখনও সখনও আমাকেই মালিশ করিতে হয়

সুতরাং আপনি আমার অবস্থা অনুমান করিতে পারিতেছেন ইহার পরেও আপনি নানান কারণ দেখাইতে পারেন তাহার আগে আপনাকে দুইটি কথা জানানোর আছে
) আমি ঠাকুর্দার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তাঁহার টাকাপয়সা তিনি যে গোপন কুঠুরিতে রাখিতেন, তাহার খবর আমি জানি আর আপনি জানেন তাঁহার মৃত্যুর পর সেই কুঠুরি আপনি ব্যবহার করেন তাহাও আমি জানি
) কোন সদুপায় না হইলে আর দশ দিনের মধ্যে আমি সপরিবারে গ্রামে যাইব এবং সুরবালা কুমুদিনী কে আপনার ওখানে রাখিয়া আসিব আমি জানি আপনার দুর্বল দৃষ্টির কারনে দেবু আপনাকে পত্র পাঠ করে শোনায়, সুতরাং দেবুর উদ্দেশ্যে এই কথা বলি যে, ‘ভাই আমি তোমাকে সেই গোপন কুঠুরির সন্ধান দিব, তুমি তোমার দুই বৌঠানের দায়ভার সামলিও 

আপনি ভাল থাকিবেন এবং আমার প্রণাম লইবেন, দেবুকে আমার স্নেহ দিবেন 

ইতি

আপনার অধম পুত্র কানাইলাল



কিছুদিন  পরে……….



                                                                                             ১০ই আষাঢ়, ১৩২১সন
পূজনীয় পিতৃদেব

গতকালমানি অর্ডারপাইয়াছি। প্রণাম নেবেন

ইতি

কানাইলাল